অপদার্থ, হোপলেস, এবং একটি ভালবাসার গল্প

মজিদ সাহেব বেশ মনক্ষুণ্ণ হলেন । সেই তারাবির নামাজের পর ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ীর উদ্দেশ্যে (উলিপুর, কুড়িগ্রাম) রওনা দিয়েছেন । লম্বা জার্নি, এই অসুস্থ শরীরে একটু বেশিই না হয় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তাই বলে ওনাকে একা গাড়িতে রেখে সবাই সেহরি খেতে চলে গেলো । ওনার ঘুম সারাজীবনই খুব হালকা । এক ডাকেই, ওনার ঘুম ভাঙ্গে । গাড়ির দরজা জানালা সব আটকানো । চীৎকার করে ডাকলেও আশে পাশের কারো শোনার উপায় নেই। দেখে মনে হচ্ছে রংপুর-বগুড়া হাইওয়ের আশে পাশেই আছেন । বড় ছেলেটা আসলেই একটা অপদার্থ, হোপলেস । [ মজিদ সাহেব রেগে গেলে সাধারণত এই ভাবেই নিজের কাছের মানুষদের তিরস্কার করেন ]

মজিদ সাহেবের বড় ছেলের উপর সাধারণত উনি রাগতে পারেন না। সংসারের খুব টানাটানি আর অভাবের সময় বড় ছেলের জন্ম। খেয়ে না খেয়ে ছোটবেলাটা পার করেছে । ছেলেটা সেই ছোট থেকেই চুপচাপ, শান্তশিষ্ট, লাজুক মুখে সব সময় লেগে থাকে হাসি । ছেলে কখনো নিজ থেকে কিছু আবদার করেছে মনে করতে পারলেন না । যা দিতে পেরেছেন তাতেই ছেলে খুশি । ওনার বাকি দু’ ছেলেমেয়ের উনি নাম ধরে ডাকেন । কিন্তু বড় ছেলেকে কদাচিৎ নাম ধরে ডাকলেও, সাথে ‘ বাবা ‘ শব্দটা ব্যবহার না করলে শান্তি পান না । কিন্তু ছেলে এমন মুখচোরা; ছেলের মুখে ‘ আব্বা ‘ ডাকটা শুনতেও অপেক্ষায় থাকতে হয় অনেক। লাজুক লাজুক ভঙ্গিতে কোন সম্বোধন ছাড়াই কথা শুরু করবে । অপদার্থ কোথাকার।

কিছুদিন আগেও বড়ছেলের সাথে রাগ করে ঢাকা ছেড়ে রংপুরে থিতু হলেন। কিছুদিন পরেই ছেলের ফোন । এমন কথা বললো, চোখে পানি এসে গেলো। মসজিদে ছিলেন, বাসায় এসে ছেলের মাকে বললাম – সব গোছাও, কালকেই ছেলের বাসায় যাবো ।

আজকে দুপুর বেলা মডার্ন হাসপাতালের ICU তে যখন ওনার শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো, ডাক্তাররা ছোটাছুটি করতে লাগলো । আমার ডাক্তার ছেলে ( ছোট ছেলে ) হন্তদন্ত হয়ে আমার বিছানার কাছে এসে দাড়াল । মনিটরে দেখাচ্ছে দ্রুত অক্সিজেন লেভেল নামছে । বড় ছেলেকে পাওয়া যাচ্ছে না আশে পাশে । আমিও অপেক্ষা করতে পারছিনা, প্রচণ্ড ঘুম আমাকে তলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে । নাহ অপদার্থ ছেলেটাকে মনে হয় শেষ দেখা হবে না ।

এমন সময় বড় ছেলে শান্তভাবে ICU তে ঢুকে বাবার ডানহাতটা তার ডানহাতে নিয়ে বাবার মুখের দিকে অবিচল, নিঃস্পৃহ ভাবে তাকিয়ে রইলো । মজিদ সাহেবের মনটা এখন একটু হালকা লাগছে, সুখী সুখী বোধ হচ্ছে। চাইলেন চোখ মেলে প্রাণভরে তার দুই ছেলেকে দেখেন । কিন্তু এমন গাঢ় ঘুম, কোন ভাবেই চোখ মেলে তাকাতে পারলেন না। অক্সিজেন মাপক মনিটরের গ্রাফ সরল রেখায় এসে বীপ বীপ শব্দ করতে লাগলো ।

ছেলের পায়ের আওয়াজ পাচ্ছেন মনে হচ্ছে । হ্যাঁ তাইতো । এতো তাড়াতাড়ি সেহরি খাওয়া হয়ে গেলো । ছেলেটা ঠিকমত খেলোও না । মজিদ সাহেবের মনটা আবার ভালো হয়ে গেলো । অপদার্থটা কাছাকাছি থাকলেই ওনার মনটা কেন জানি ভালো হয়ে যায় ।

লাশবাহি গাড়ির পিছনের হুড খুলে মজিদ সাহেবের বড় ছেলে শহীদ বাবার কফিনের পাশে বসলো । গাড়ি আবার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছুটতে লাগলো। কফিনের উপর দিয়ে বাবার হাতে হাত রেখে বলল – ” আমি দুঃখিত বাবা । তোমাকে ছাড়া খেতে যাবার জন্য । জীবনের সব জার্নিতে তুমিই আমাকে নিয়ে গেছো, পথ দেখিয়েছ । এই প্রথম কোন জার্নিতে তোমাকে আমি নিয়ে যাচ্ছি বাবা । “

তারিখঃ ২১ জুন ২০১৭, ১৩২৩ মিরপুর ডিওএইচএস, ঢাকা

1 Comment

  1. To my father.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *