ফুটবল খেলে নাই এরকম কাউকে এই ধরাধামে পাওয়া বিরল । যে কোনো খেলাও পারেন না, সেও অন্তত দুই একবার লাথি মেরে দেখার চেষ্টা করেছেন, ইহার ‘ফুটবল’ নামকরনের কারণ কী । লাথি মারা খারাপ কাজ কিন্তু ইহা এমন একটি বস্তু যাকে লাথি মারাই আনন্দ, আবার দর্শকও দেখিয়া খুশি। এই লাথির কসরত দেখাইয়া কেউ পেলে, কেউ ম্যারাডোনা আবার কেউ বা হালের মেসি, রোনালদো, কিংবা নেইমারের মত সুপার স্টার হয়েছেন ।
বাঙ্গালীর কথাতো বলাই বাহুল্য । হুজুগে বাঙ্গালীর যদি চাক্ষুষ প্রমাণ চান তাহলে পাড়ার ফুটবল অথবা জাতীয় দলের যে কোন একটা খেলা দেখলেই পরিষ্কার হবে । যেখানে বল (হুজুগ) সেখানেই ২২ জন খেলোয়াড়। এমনকি কোন এক গুরুজন বলেছেন আমাদের জাতীয় কবিও নাকি “ আমরা শক্তি আমরা বল, … আমরা ছাত্র …। ” এখানে “বল” বলতে ফুটবলের কথাই বলেছেন ।
আমাদের সময় কলেজে ‘ভূগোল’ এ পৃথিবী গোল প্রমান করবার জন্য স্যাররা কত কষ্ট করিয়াই না বিভিন্ন লজিক শিখিয়ে ছিলেন । কিন্তু সবচেয়ে সহজ (এবং অবৈজ্ঞানিক) তত্ত্বটা স্যাররা শিখাতে ভুলে গেছেন । “ যেহেতু ফুটবল গোল অতএব প্রমানিত হইল যে পৃথিবীও অবশ্যই গোলই হইবে । “ – ইহাই তো পৃথিবী গোল প্রমাণিত হইবার জন্য যথেষ্ট আর অন্য যুক্তির দরকার আছে কি ?
যখন ক্লাস টু – থ্রীতে প্রথম সিরিয়াস (!) ফুটবল খেলা শুরু করলাম, পাড়ার বড় ভাইরা বললেন যা তুই তো কিছু পারবিনা । তুই গোল কীপার । বামে ড্রাইভ/ডাইভ ডানে ড্রাইভ, পেট সংকুচিত করে বল গ্রিপ (যাতে পেটে ব্যথা না লাগে) করা কয়েকদিনের মধ্যে বড় ভাইরা শিখিয়ে দিলেন । সমস্যা হল সব দোষ নন্দঘোষের মত পাড়ার খেলায় গোল হলে সব দোষ গোল কিপারের ! আবার পরদিন ক্লাসমেটদের টিটকারি – কিরে কয়টা (গোল) খাইলি। ইহাতক আর কয়দিন । গোঁ ধরলাম এবার থেকে আমাকে ‘উপুরে’ (ফরওয়ার্ড) খেলতে দিতে হবে । ফরওয়ার্ডে খেলতে গিয়ে বড় ভাইদের সাথে পায়ের শক্ত হাড্ডিতে লেগে প্রায় প্রদিতিন খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাসায় ফিরতে লাগলাম । আমাদের সময় মা রাও ছিলেন বেরসিক । কোথায় ছেলের পায়ের ব্যথায় মালিশ করে দিবেন । তা না উল্টো পিঠে লাঠি দিয়ে মালিশ করে আল্টিমেটাম দিলেন আর এক দিন যদি খোঁড়াতে দেখি তাহলে তোর একদিন কী আমার একদিন ।
এতদিনে বুঝতে পেরেছি Striker না হলে মজা নাই । সব নাচানাচি গোলদাতাকে নিয়ে। গোল দিতে না পারলে জীবন বৃথা । পাড়ার খেলায় সবাই Striker ফলে নতুন Striker হওয়া সহজ কথা নয় । ভাগ্য প্রসন্ন বাবার বদলির কারনে নতুন শহরে গেলাম (গাইবান্ধা থানা পাড়া ) এবং Striker হিসাবে নাম লেখালাম । কয়েকদিনের মধ্যে পাড়া কাঁপানো ( হা হা ) Striker হয়ে গেলাম । বড় ভাইরা থানা পাড়ার ছোটদের সাথে পাশের পাড়ার “শিল (অধুনা কাপ) ” দিয়ে খেলার আয়োজন করলেন। মিতু ভাই, শিমুল ভাই আমাদের কোচ । থানার ভিতরে মাসজিদের পশ্চিম পাশে মাঠে খেলা । শাহিন আমাদের গোল কিপার আর তারিক ( তাংকু বেপারী ) আমাদের ডিফেন্ডার । বাকি সবাই যথারীতি Striker । কিন্তু খেলার দিন দেখি শাহিন নাই, কই গেল । আমাদের একমাত্র সবে ধন মনি কিপার। মাঠে গিয়ে তো সবার চোখ ছানাবড়া । শাহিন দেখি ঐ দলের গোল কিপার, দাতঁ কেলায়ে হাসতেছে । এতবড় বেঈমানি ।
শেষ পর্যন্ত ভিতুর ডিম জিয়াকে জোর করে গোল কিপার বানানো হল । সবাই বলের পিছে দৌড়ায় আর জিয়া বল আসতে দেখলে উল্টা পালায় । যাইহোক খেলা শুরু হল । আক্রমণ প্রতি আক্রমণে, লাথালাথিতে, ধাক্কা ধাক্কিতে, হাততালিতে চরম উত্তেজনাময় খেলা চলতে লাগলো । ডি-বক্সে হ্যান্ডবল হবার কারণে আমরা প্লান্টী কিক (অনেক পরে শিখেছিলাম এটা পেনাল্টি কিক ) পেলাম । পেনাল্টি কিক শাহিন রুখে দিল । চারিদিকে দুও ধ্বনি, যতনা Striker-এর জন্য তার চেয়ে বেশি বিশ্বাসঘাতক শাহিনের জন্য । একেই বলে দুধ কলা দিয়ে সাপ পোষা ।
পাল্টা আক্রমনে প্রতিপক্ষের একজন উঁচু দিয়ে বল মারল আমাদের গোলে । জিয়া মাথা বাচানোর জন্য, ও মাগো বলে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো । গোল গোল, জীবনের প্রথম শিলের খেলায় হেরে গেলাম। সন্ধায় পাড়ায় ফিরেই জরুরী মিটিং । তিনটি কঠিন সিন্ধান্ত নেওয়া হল শাহিনের ব্যাপারেঃ (১) মীরজাফরের নামানুসারে শাহিনকে ডাকা হবে ‘মীরশাহিন’ বলে (২) আমাদের পাড়ায় শাহিন আজীবন নিষিদ্ধ (৩) কাউকে শাহিনের সাথে দেখলে সরাসরি লালকার্ড ।
১৯৮৭ পর আর কখনও গাইবান্ধায় ফেরা হয়নি । কয়েক বছর আগে ব্রাক সেন্টারের সামনে দাড়িয়ে আছি । কে একজন পিছন থেকে ডাকনাম ধরে ডাকছে । এতদিন পরেও মীরশাহিনকে চিনতে অসুবিধা হল না । । ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে, ধরা গলায় বলল “ বন্ধু কত দিন পর দেখা ! কেমন আছিস “ ।
ফুটবল এমনই একটি খেলা অন দ্য ফিল্ড বাঘে বাঘে লড়ায়, কিন্তু অফ দা ফিল্ড নানা বর্ণের, বয়েসের, জাতির, সংস্কৃতির, সময়ের মানুষকে ‘এক’ সুরে জড়ায় । এখানেই বোধহয় ফুটবলের সবচেয়ে বড় মাহাত্ম্য । বিশ্বকাপ ২০১৮ সুস্বাগতম ।
[ বিঃ দ্রঃ উপরের কাহিনির সাথে যদি কোন ঘটনা, স্থান, বা চরিত্রের মিল পাওয়া যায়, তার জন্য নাটেরগুরু লেখককে অবশ্যই দায়ী করা যাইবে । ]
Leave a Reply